১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১—চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সঙ্গে তিনি শুধু নিবিড়ভাবে জড়িতই ছিলেন না, উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় জ্যেষ্ঠ সন্তানকে। হ্যাঁ, শরীফ ইমামের কথাই বলছি, যিনি ছিলেন স্বাধীনতা-পূর্ব ঢাকার প্রকৌশল জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। মুক্তিযুদ্ধের এই নেপথ্য নায়ক ব্যক্তিজীবনে ছিলেন জাহানারা ইমামের স্বামী এবং শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমীর বাবা। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিনয়ী, মৃদুভাষী ও অমায়িক চরিত্রের অধিকারী শরীফ ইমামের জন্ম ৩০ অক্টোবর, ১৯২৭ সালে। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও শরীফ ইমাম ছিলেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাঁর অনুপ্রেরণায় জাহানারা ইমাম শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিজেকে বিকশিত করতে পেরেছিলেন। বাবা হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় গড়ে ওঠে তরুণ রুমীর ব্যক্তিত্ব, মেধা ও দেশপ্রেম।
শরীফ ইমামের মনের গহিনে দেশপ্রেম ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল এই বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক মানুষটিকে। জাহানারা ইমামের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে শরীফ ইমামের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়গুলো স্পষ্টই ফুটে উঠেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছে বাংলাদেশের সেতু ও কালভার্টের তালিকা চেয়ে পাঠান। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেছিলেন। কেননা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অফিসের ওপর আইবির আগে থেকেই নজরদারি ছিল। সারা দেশের সব সেতু ও কালভার্টের তালিকা তৈরি করা সহজ ছিল না। শরীফ ইমাম তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু এস আর খান বাঁকা ও সামাদ সাহেবকে নিয়ে তিন দিন ধরে ৩ হাজার ৫০০টি সেতু ও কালভার্টের তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন। শরীফ ইমামের বাসভবন ‘কণিকা’ ১৯৭১ সালে গেরিলাযোদ্ধাদের পদচারণে মুখর ছিল। ২৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে দুর্ধর্ষ অপারেশন সেরে আসা রুমী ও তাঁর দলের অস্ত্রশস্ত্র নিজ বাসভবনে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে শরীফ ইমাম সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য শরীফ ইমাম তাঁর অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব নেন। তিনি ক্রমান্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট আনুমানিক রাত ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শরীফ ইমাম, তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ছেলে রুমী, কনিষ্ঠ ছেলে জামী, রুমীর বন্ধু ও চাচাতো ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। বন্দিশিবিরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শরীফ ইমাম রুমীকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার সব প্রশ্ন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে উত্তর দেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বন্দিশিবির থেকে ফিরে আসার পর শরীফ ইমাম বাইরে কঠোর মনোভাব বজায় রাখলেও ভেতরে-ভেতরে পুত্রশোকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে উল্লেখ করেছেন, তিনি জীবনে কখনো শরীফ ইমামকে কাঁদতে দেখেননি। এই প্রথম তিনি রুমীর নাম করে কাঁদলেন। রুমীকে উদ্ধার করার জন্য শরীফ ইমামের শুভানুধ্যায়ীরা মার্সি পিটিশন করার কথা বললেও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শরীফ ইমাম তাতে রাজি হননি। কেননা যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, সেই সরকারের কাছে মার্সি পিটিশন করলে রুমীর আদর্শ হেয় প্রতিপন্ন করা হবে। তাই প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শরীফ ইমাম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও ছেলের জীবনের চেয়ে দেশ ও ছেলের আত্মসম্মানকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রুমীকে বের করে আনার যত চেষ্টা আছে করবেন, কিন্তু মার্সি পিটিশন করে নয়।
চাপা প্রকৃতির শরীফ ইমাম পুত্রশোক, বন্দিশিবিরে অত্যাচারের জের ও অপমানের বোঝা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। শেষমেশ ১৩ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শরীফ ইমাম ও তাঁর মতো পর্দার অন্তরালে থাকা মানুষগুলোর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি জাতির গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।